রাঙা বৌদি । সোমা মুৎসুদ্দী

0
399
ছোট গল্পঃ রাঙা বৌদি
লেখিকাঃ সোমা মুঃসুদ্দী
আমি অরিন্দম, ছোটবেলা কোন এক বাস দুর্ঘটনায় আমার বাবা, মা কে হারাই, বাবা ছিলো আমার দাদু ঠাকুমার একমাত্র ছেলে, কাজেই তারা মুষড়ে পড়ায় আমাকে দেখার কেউ ছিলোনা। এদিকে দাদু, দিমা ও বেশ মুষড়ে পড়ে কারণ আমার মা ও ছিলো দাদু ও দিমার খুব আদরের মেয়ে। দাদুর তিন ছেলে ও এক মেয়ে আমার মা ছিলেন সবার ছোট।আমিও মা আর বাবার অভাব তীব্র অনুভব করছিলাম। ঠিক যখন দুপুর বেলা খাবার সময় মায়ের কথা খুব মনে পড়তো আর কান্না পেতো কারণ মা আমাকে অরি অরি বলে ডাকতো আর ভাত খাইয়ে দিতো।এই ঘটনার কিছুদিন পর দাদু আর দিমা আমাকে নিতে আসে, আর দাদু ও ঠাকুমাকে বলে অরিকে নিতে এলাম, আমাদের কাছে ও ভালোই থাকবে ওর কোনো অযত্ন হবেনা, দাদু প্রথমে আপত্তি জানালেও পরে আমার ভালোর হবে এই চিন্তা করে রাজি হলেন। আর শর্ত ছিলো তিনমাস পরপর আমাকে দুদিনের জন্য নিয়ে আসবেন।
দাদু আর ঠাকুমা রাজি হলেন। যথারীতি ব্যাগ গোছানো হলো, আর তারপর ঠিক চলে আসার সময় দাদু আর ঠাকুমা আমাকে জড়িয়ে ধরে খুব কান্না করলেন সাথে আমিও কারণ দাদু ঠাকুমাকে ছাড়া কোনদিন এভাবে যেতে হবে ভাবিনি যদিও ছোট ছিলাম কিন্তু আবেগটা ছিলো বেশি, বেশি না বুঝলেও তাদের আদর ভালোবাসা বেশ বুঝতাম।তারপর এবার আমার ঠাঁই হলো মামাবাড়িতে। মামা বাড়িতে গিয়ে কয়েকদিনের মধ্যে সব কষ্ট মন থেকে সরে যাচ্ছিল কারণ পরিবারের সবাই আমাকে আপন করে নিলো, এমনকি মামা বাড়ির চাকর বাকর বা ঝিয়ের কাজ যারা করত তারাও আমার যত্ন নিতে ভুলতোনা অল্পকিছুদিনেই আমি মামা বাড়িতে রাজপুত্র হয়ে গেলাম। দাদু আমাকে নতুন স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিলেন। আমিও তাদের সব কথা মেনে চলতাম। বিকেল বেলা বড় মামা যখন হাটে যেতেন আমাকেও সাথে নিয়ে যেতেন, আসার সময় মনোহরি দাদুর দোকান থেকে চার আনা দামের অনেকগুলো চকোলেট কিনে দিতেন, আমি বাড়িতে এসে সবাইকে নিয়ে ভাগ করে খেতাম। আমার মামাত ভাই, বোনগুলোও ছিলো বেশ মিশুক। আমি যাওয়ার প্রায় ছয়মাস পর দাদুর খুব ইচ্ছে হলো, বড়দাকে বিয়ে করানোর।বড়দা বড়মামার ছেলে, বিলেতে থাকে, দেশে আসবে তাই দাদুর খুব ইচ্ছে তাকে এবার বিয়ে করানোর।যেই বলা সেই কাজ পাঁচ গ্রাম ঘুরে দেবী দূর্গার মতো এক মেয়ের সন্ধান পাওয়া গেলো।
নাম মাধুরী দেবী, দেবীর মতই সুন্দর। আমাদের সব ভাই,বোনদের মাঝে আনন্দ আর ধরে না পুরো বাড়িটাই যেনো খুঁশিতে হৈচৈ পড়ে গেলো। যথারীতি বড়দা এলো, আর সবার জন্য সব উপহার আনলো সাথে আমার জন্য নিয়ে এলো খেলনা গাড়ি। তারপর একসময় বিয়ের বাজার ও হলো আর তারপর একদিন মাধুরীদেবী বড়দার বউ হয়ে আমার মামা বাড়ি এলেন। যেনো দেবী দূর্গার পা পড়লো মামা বাড়িতে।বড়দারও বেশ পছন্দ হলো বড় বৌদি কে। আমি বড় বৌদিকে বড় বৌদি না ডেকে রাঙা বৌদি বলেই ডাকতাম। কারণ অপুর্ব সুন্দরী ছিলো বড় বৌদি।তার বয়স ও ছিলো সতের বছর দাদুর মুখে শোনা। মামা বাড়ি আসার কিছুদিনের মধ্যেই বড় বৌদি সবাই কে খুব আপন করে নিলো, বড় বৌদি ছিলো রুপে গুনে অদ্বিতীয়া। কথায়, চলনে-বলনে কাজে কর্মে ছিলো শিল্পের ছাপ। বৌদি আমাকেও খুব আপন করে নিলো, নিজ হাতে খাইয়ে দিতো, কোথাও গেলে আমাকেও সাথে নিতো একটা সময় আমি বৌদিকে মায়ের আসনেই বসালাম কারণ আমার সব কিছু শোনার পর আমার প্রতি বৌদির একটা টান বেড়ে গেলো। বৌদির অনেক গুনের মধ্যে আরেকটি বড় গুন ছিলো আর তা হলো বৌদি ছিলেন সাহিত্যানুরাগী, শরৎচন্দ্রের বই বৌদি খুব পড়তেন বিশেষ করে দুপুরে মামা বাড়িতে খাওয়া দাওয়ার পর যখন সবাই ঘুমিয়ে পড়তো তখন বারান্দায় বসে বসে বৌদি আমায় মহেষ গল্পটা শোনাতেন আমি তা শুনে কান্না করে দিতাম, বৌদি বলতো দুর বোকা কান্না করতে আছে এটাতো গল্প। আমি বলতাম রাঙাবৌদি তুমি দাদার সাথে বাইরে চলে গেলে কে আমাকে গল্প শোনাবে।বৌদি বলতো আমি গেলে তোকেও নেয়ার ব্যাবস্থা করবো, এভাবে বেশ কিছুদিন আনন্দে কাটলো তারপর প্রথমেই বড়দা চলে গেলেন, তারপর বড়দা যাওয়ার ছ মাসের মাথায় বৌদিও চলে গেলেন, সবাই কে কাঁদিয়ে সাথে আমাকেও আর বললেন অরি আমি তোকে ছাড়া থাকতে পারবো না, আমি তোকে ঠিক নিয়ে যাবো।
আমি আর বৌদি খুব কান্না করলাম। বৌদি চলে গেলেন, তার পর একদিন বিকেলে খবর এলো মামার কাছে বৌদি আর বেঁচে নেই। সবাই খুব কান্না করলো আর আমার মনে হলো আবারো আমার মা মরে গেছে, মা মারা যাবার পর আমি রাঙা বৌদির কাছেই মায়ের আদর ভালোবাসা পেয়েছিলাম। তারপর আমার দিনের পর দিন কেটেছে বৌদির কথা ভেবে, এই ঘটনার বিশ বছর পর আমিও বিলেত গিয়েছি তারপর কোনো এক বাঙালী ভদ্রলোকের মুখেই শুনি বৌদিকে খুন করা হয়েছিলো। এত বছর পরেও আমি বৌদিকে ভুলতে পারিনি, পারিনি মাধুরী দেবী দূর্গা কে আমাকে দুপুর বেলা গল্প শোনানো আমার রাঙা বৌদিকে।মামা বাড়িতে পুরো বাড়িটাই যার নুপুরের আওয়াজে মাতিয়ে রাখতো সেই রাঙা বৌদিকে।

এফএম নিউজ…আপনার এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী

বিজ্ঞাপন ও বার্তা বিভাগঃ 0183 11-06 108