পাক-ভারতে পঙ্গপালের বংশবিস্তারঃ ঝুঁকিতে ১০ দেশ

0
368

প্রতিবেদকঃ রোদেলা হক ভূঁইয়া, আর্ন্তজাতিক বিভাগ

করোনার মধ্যেই আরব উপসাগরের ঊষর মরুভূমিতে পঙ্গপালের বংশবিস্তার ঘটছে ব্যা’পকহারে। এতে নজিরবিহীন পরিস্থিতিতে পড়ে গেছে ১০টি দেশ। পঙ্গপাল ১০ দেশের কয়েক লাখ মানুষকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিতে যাচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা এমন দাবিই করেছেন বলে গার্ডিয়ানে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার পতঙ্গ বিশেষজ্ঞ কেইথ ক্রিসম্যানের বরাত দিয়ে গার্ডিয়ানের খবরে বলা হয়, ২০১৮ সালে ঘূর্ণিঝড় মেকুনু আঘাত হানলে সৌদি আরবের মরুভূমিতে আদ্র বালু ও গজিয়ে ওঠা উদ্ভিদের মধ্যে পঙ্গপালের কয়েকটি প্রজন্মের বিস্তার ঘটে। এতে করে আরব উপদ্বীপের দেশটিতে পতঙ্গটি ব্যাপকহারে বংশ বিস্তার সক্ষম হয়েছে। ইয়েমেন ও ওমানে ‘রুবয়া খালি’ নামে পরিচিত বিশ্বের সবচেয়ে বৃহৎ বালুময় মরুভূমিতে শস্যগ্রাসী পতঙ্গের ঝাঁকে ঝাঁকে জন্ম হয়।

কেইথ ক্রিসম্যান বলেন, ইয়েমেন ও ওমান দুটি দেশের পরিবেশ শুষ্ক হয়ে যাচ্ছিল, তখন অঞ্চলটিতে একটি ঘূর্ণিঝড় আঘাত হানে। এতে করে নতুন পঙ্গপালের নতুন প্রজন্মের বিস্তার শুরু হয়। ওই সময়েই পতঙ্গটির বিস্তার সেখানে আট হাজার গুণ বেড়ে যায়। একটি ঘূর্ণিঝড় পঙ্গপালের বিস্তারকে অন্তত ছয় মাসের জন্য অনুকূলে এনে দেয়।

এদিকে, জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হুঁ’শিয়ারি দিয়ে জানানো হয়েছে, পঙ্গপালের কারণে অন্তত আড়াই কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তা হুমকির মুখে পড়বে। পঙ্গপালের একঝাঁক পতঙ্গ প্রায় ত্রিশ হাজার মানুষের খাবার খেতে পারে। একটি পঙ্গপালের ঝাঁকে প্রায় ১০ লাখ পতঙ্গ থাকে।

পঙ্গপাল পর্যবেক্ষণ বিভাগ লোকাস্ট ওয়াচের মতে, সাম্প্রতিক মাসগুলোতে অন্তত ১০ দেশে এই পতঙ্গটি দেখা গেছে। ঝাঁকবদ্ধ পতঙ্গ পঙ্গপালের তীব্র আক্রমণে বিপাকে পড়েছে পাকিস্তান। ইতোমধ্যে ঘোষণা করা হয়েছে জরুরি অবস্থা। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও ঢুকে পড়েছে পতঙ্গটি। এছাড়া সোমালিয়াতেও সম্প্রতি এ নিয়ে জরুরি অবস্থা জারি করা হয়েছে।

জাতিসংঘের এক সতর্কবার্তায় বলা হয়েছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া, সোমালিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকায় পঙ্গপালের আক্রমণে মানবিক সংকট তৈরি হতে পারে। জিবুতি ও ইরিত্রিয়ায় ৩৬ হাজার কোটি পতঙ্গের আক্রমণে খাদ্য নিরাপত্তায় ভয়াবহ হুমকি তৈরি হয়েছে।

কোরআনেও পঙ্গপালের বর্ণনা রয়েছে। এগুলোকে বাইবেলে বর্ণিত আল্লাহ্‌র গজব হিসেবে দেখছেন ইসরাইলিরা। ফেরাউনের ওপর গজব হিসেবে পঙ্গপালের আক্রমণ হয়েছিল। পবিত্র কুরআন, বাইবেল ও গ্রিসের ইলিয়াডের মতো একাধিক ধর্মগ্রন্থে এসব পতঙ্গের আক্রমণকে সৃষ্টিকর্তা প্রদত্ত শাস্তি হিসেবেও উল্লেখ করা হয়েছে।

মরু অঞ্চলে জন্ম নেওয়া এই পঙ্গপাল আফ্রিকার বিভিন্ন দেশের পর বর্তমানে পাকিস্তানে আক্রমণ করেছে। আর এতেই আতঙ্কে রয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতও।

জেনে নিন মহামারি আকারে আর্বিভূত হওয়া ফসল খেকো এই পতঙ্গ সম্পর্কে চমকপ্রদ কিছু তথ্য : বিশ্লেষকদের মতে, পৃথিবীর প্রাণিজগতের মধ্যে অত্যন্ত বিস্ময়কর আচরণ দেখাতে সক্ষম এই পঙ্গপাল। কেননা অন্য কোনো প্রাণী এই পতঙ্গের মতো এত বড় দল নিয়ে নাটকীয়ভাবে দ্রুত আবির্ভূত হয় না। আর্কিডিডি পরিবারে ছোট শিংয়ের বিশেষ এই প্রজাতিটি মূলত বিশাল বিশাল ঝাঁক বেঁধে একত্রে আক্রমণ সাজায়। এতেই মাঠের পর মাঠ ফসল উজাড় হয়ে যায় মুহূর্তে। প্রায় ১০ লক্ষাধিক পতঙ্গের একটি ঝাঁক প্রতিদিন ৩৫ হাজার মানুষের খাদ্য সাবাড় করতে সক্ষম।

ঘাস ফড়িং এবং পঙ্গপালের মধ্যে বিস্তর পার্থক্য রয়েছে। কেননা ঘাস ফড়িং একাকী বসবাস করে আর পঙ্গপাল থাকে দলে। একক পঙ্গপালকে ইংরেজিতে বলা হয় লুকাস (Locust) ও তাদের ঝাঁককে বলা হয় লুকাস সোর্ম (Locust Swarm)। একা থাকাকালীন পঙ্গপাল কখনোই কৃষি পণ্যের জন্য তেমন ক্ষতিকর নয়। যদিও বিশেষ বিশেষ কিছু প্রাকৃতিক পরিবেশে পতঙ্গটির আচরণগত বিরাট পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। মূলত তখনই তারা মারাত্মক ক্ষতিকর পতঙ্গে পরিণত হয়।

বিজ্ঞানীদের মতে, পঙ্গপালের মস্তিষ্কের বিশেষ পরিবর্তনের কারণে তারা অতি দ্রুত বহুসংখ্যক সন্তান জন্ম দিতে পারে। এর মাধ্যমেই তারা সামান্য থেকে ধীরে ধীরে অতি বিশাল একটি দল গড়ে তোলে। পঙ্গপালের সংখ্যা অসম্ভব রকমের বৃদ্ধি পেলেই এদের মধ্যে উড়ে বেড়ানোর প্রবৃদ্ধি দেখা দেয়। তখন দলটি খাদ্যের গন্ধ নিয়ে নতুন নতুন খাবারের সন্ধান করে। যতক্ষণ কোনো অঞ্চলে খাদ্য শস্য আছে ততক্ষণই এরা সেখানে অবস্থান করে। কোনো একটি এলাকার খাদ্য শস্য শেষ হয়ে গেলে পতঙ্গগুলো নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ স্থাপন করে অতি দ্রুত অঞ্চলটি ত্যাগ করে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি নিউজ জানিয়েছে, পোকাগুলোর উপদ্রব ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কোনো কার্যকরী পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি। তাছাড়া মাটিতে পঙ্গপালের ডিম দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। এমনকি ২০ বছর পরেও পতঙ্গটির ডিম থেকে বাচ্চা হতে পারে। যদিও বাচ্চাগুলো শুরুতে উড়তে পারে না। অল্প বয়সে এগুলো লাফিয়ে লাফিয়ে চলাচল করে। সাধারণত একটি বাচ্চা পঙ্গপালের পূর্ণ বয়স্ক হতে সময় লাগে প্রায় ৪ সপ্তাহ। এ সময় তাদের শারীরিক গঠন খুব দ্রুত বৃদ্ধি পায়।

বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, একটি প্রাপ্ত বয়স্ক পঙ্গপাল প্রতিদিন নিজের ওজনের প্রায় সমান খাদ্য গ্রহণ করে। আর পোকাগুলোর একটি ঝাঁক অল্প সময়ে হাজার হাজার টন খাদ্য শস্য খেয়ে ফেলতে পারে। এসব পতঙ্গ প্রতিনিয়ত দল বেঁধে সামনের দিকে এগোতে থাকে। যাতায়াতের সময় পঙ্গপাল বাতাসের ওপর নির্ভর থেকে নিজের শরীরের শক্তি সঞ্চয় করে। মূলত বাতাসের গতিপথ অনুসরণের মাধ্যমে এগিয়ে চলে বলেই বাতাস যে দিকে যায় পঙ্গপালও সে দিকে আক্রমণ চালায়। যাত্রাপথে এক একটি পঙ্গপালের দল নতুন নতুন ঝাঁকের সঙ্গে মিলিত হয় এবং কয়েকটি বড় বড় ঝাঁক একত্রিত হয়ে আরও অতিকায় ঝাঁকের সৃষ্টি করে।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান

এফএম নিউজ

আপনার এগিয়ে যাওয়ার সঙ্গী

বিজ্ঞাপন বার্তা বিভাগঃ 018-311 06 108